পাশাপাশি বাড়ির দুই পরিবার। দুই পরিবারের ছেলে-মেয়েতে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু স্ত্রী তালাকের পর শাশুড়িকে বিয়ে করেছেন জামাতা। মাঝে দুই বছর প্রবাসে ছিলেন। সম্প্রতি গ্রামের বাড়িতে এসে বসবাস শুরু করলে বিব্রত স্বজনেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। যোগ দেন প্রতিবেশীরাও। বাধ্য হয়ে চেয়ারম্যান সালিস ডেকেছেন। রেখেছেন কয়েকজন মাওলানাকেও। তবে প্রচলিত গ্রাম্য সালিসের মতো শাস্তি ঘোষণা আর তা কার্যকর করার উদ্যোগ না নেওয়ায় ধাওয়া খেতে হয়েছে তাঁদের। কিন্তু সালিসকারী ব্যক্তিরা ছিলেন অনড়। বলেছেন, ইসলামের দৃষ্টিতে দোররা ও পাথর মারার মতো অপরাধ করেছেন অভিযুক্ত ব্যক্তিরা। কিন্তু দেশের প্রচলিত আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ কারও নেই। আইন হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ তাঁদের নেই।
গত সোমবার এ ঘটনাটি ঘটেছে মাদারীপুর সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের একটি গ্রামে (গ্রাম ও ঘটনার পাত্র-পাত্রীর নাম প্রকাশ করা হলো না)।
সালিস বৈঠকে উপস্থিত ব্যক্তি এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় সাত বছর আগে পাশাপাশি বাড়ির দুই তরুণ-তরুণীর বিয়ে হয় পারিবারিকভাবে। তখন বরের বয়স ছিল ২৮, কনের ১৯। য়ের কিছু দিন পর শাশুড়ির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে জামাতার। ঘটনাটি স্ত্রীর নজরে এলে তিনি প্রতিবাদ করেন। এর জন্য তাঁকে মারধরও করা হয়। বিয়ের ছয়-সাত মাস পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। অভিভাবকদের নিয়ে স্ত্রী-ই উদ্যোগ নেন তালাকের।
এরপর ‘সাবেক শাশুড়ি’কে নিয়ে ঢাকা, মাদারীপুর ও রাজৈরে বসবাস শুরু করেন ‘সাবেক জামাতা’। সবশেষে রাজৈরে একটি ভাড়া বাসায় ‘সাবেক শাশুড়ি’কে রেখে সৌদি আরব চলে যান ‘সাবেক জামাতা’। দুই বছর সেখানে থাকার পর ২৫ দিন আগে তিনি দেশে ফেরেন। তাঁদের দাবি, ১৫ দিন আগে তাঁরা মাদারীপুরে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেছেন। এক সপ্তাহ আগে তাঁরা গ্রামে ফিরে আসেন স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে।
এলাকার বাসিন্দা হাবিব বেপারী সালিস বৈঠকে দাবি করেন, ইসলাম ধর্মমতে ও দেশের আইনে আপন শাশুড়িকে বিয়ে করা অবৈধ। তা ছাড়া শাশুড়ির বাবার বাড়িও পাশাপাশি। এ অবস্থায় তাঁরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে এলাকায় এসে বসবাস করায় ছেলে-মেয়ে, পরিবারের লোকজন ও আত্মীয়স্বজন বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। সালিসে ছেলের বাবাও তাঁর সন্তানের যেকোনো শাস্তি মেনে নেওয়ার কথা জানান।
যাঁদের বিরুদ্ধে সালিস, নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তাঁদের বৈঠকস্থল থেকে একটু দূরে রাখা হয়। সালিসদারেরা সেখানে গিয়ে দুজনের বক্তব্য নেন এবং এসে উপস্থিত হাজারখানেক মানুষকে জানান। ভাষ্যটি এমন, ‘প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে আমার তালাকের মাধ্যমে বিচ্ছেদ হয়েছে দীর্ঘদিন আগে। আমার বর্তমান স্ত্রীও (সাবেক শাশুড়ি) তাঁর স্বামীকে তালাক দেন প্রায় একই সময়ে। এরপর তিনি চরমুগরিয়ায় একটি বিয়ে (হিল্লা বিয়ে) করেন। সেখান থেকেও তালাক নেন। এরপর অবৈধ নয় মনে করেই কাবিন রেজিস্ট্রি করে তাঁকে (সাবেক শাশুড়ি) বিয়ে করেছি। এখন বিচারে যা হয় আমি মেনে নেব।’
গ্রামের একটি খোলা জায়গায় ওই সালিসে উপস্থিত ছিলেন ইউপির চেয়ারম্যান মোতাহার চৌকিদার, সাবেক চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) সাহেব আলী, সুলতান মাতুব্বর, পল্লিচিকিৎসক সিরাজুল ইসলাম, হাবিব বেপারী। ঘটনার বিষয়ে ইসলামের বিধান সবার সামনে উপস্থাপনের জন্য আশপাশের এলাকা থেকে দাওয়াত দিয়ে আনা হয় হাবিবুর রহমান, নাসিরউদ্দিন, নূরুল আমিন, আনোয়ার হোসেন ও সাইফুল বাশারসহ কয়েকজন মাওলানাকে।
এরই মধ্যে লোকজন ‘শাশুড়ি-জামাতা’কে সালিসে উপস্থিত করে জবানবন্দি নেওয়ার জন্য কয়েক দফা মিছিল করে। কিন্তু সালিসদারেরা রাজি হননি। সাবেক স্ত্রী সালিসে বলেন, ‘ওরা দুজন যখন একসঙ্গে থাকত, তখন আমি প্রতিবাদ করলে আমাকে মারধর করত।’ তাঁর বড় বোন (২৮) বলেন, ‘আমরা দুই বোন ঢাকা থেকে এসেছি। ওই মহিলা (মা) আমার বোনকে মাইর্যা ফেলানোর চেষ্টা করছিল। এমনকি আমার ছোট দুই ভাইকেও মারার চেষ্টা করছে। আমার বাবা আজ মৃত্যুর পথে। আমারও বিয়ে হয়েছে পাশের বাড়িতে। আমরা কীভাবে মানুষের কাছে মুখ দেখাই? আমরা তাঁদের বিচার চাই।’
সালিসে সুলতান মাতুব্বর বলেন, ‘এলাকার লোকজন আমাদের ডেকে এনেছে। বিচার করার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা মীমাংসা করতে পারি। বিচার করবে আদালত।’
আলেমদের মধ্য থেকে শাশুড়িকে বিয়ের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন মাওলানা হাবিবুর রহমান ও মাওলানা আনোয়ার হোসেন। তাঁরা বলেন, ‘উপস্থিত মাওলানারা একত্র হয়ে কোরআন ও হাদিসের আলোকে বিষয়টি পর্যালোচনা করে তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি। স্বামী বা স্ত্রী বর্তমান থাকতে যেকোনো নারী বা পুরুষ পরকীয়ায় লিপ্ত হলে তার শাস্তি ইসলামে উল্লেখ আছে। আল্লাহ পাক স্পষ্টভাবে ১৪ জন লোকের মধ্যে বিয়ে হারাম করেছেন। এখানে দাবি করা হয়েছে, তিনি (পুরুষ লোকটির নাম ধরে) স্ত্রীকে তালাক দিয়ে শাশুড়ি বিয়ে করেছেন, স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার পর ওই নারী আর তাঁর শাশুড়ি নন। কিন্তু এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। এই বিয়ে সর্ব অবস্থায় হারাম। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করা অবস্থায় আগে ও পরে যে অন্যায় করেছেন, তার জন্য তাঁদের শাস্তি পাওয়া উচিত। ইসলামের দৃষ্টিতে তাঁদের শাস্তি ‘রজম’। পরিস্থিতিতে হানাফি মাজহাবের রায় বা ফতোয়া অনুসারে এঁদের শাস্তি কমিয়ে সর্বনিম্ন তিন ও সর্বোচ্চ ৩৯ দোররাও কার্যকর করা যেতে পারে। কিন্তু আমরা যেহেতু বাংলাদেশের নাগরিক, সেহেতু দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি, সংবিধানের প্রতি আমরা সবাই শ্রদ্ধাশীল। তাই বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে তাঁদের বিচার করা যেতে পারে। আমাদের কারোই আইন হাতে তুলে নেওয়ার ক্ষমতা নেই। বিষয়টি ইসলামি দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য আমাদের এই মজলিসে আনা হয়েছে। তাই আমরা এই ব্যাখ্যা প্রদান করেই বৈঠকস্থল ত্যাগ করলাম।’
এরপর সালিসের সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান মোতাহার চৌকিদার বলেন, ‘আমরা ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা শুনলাম। তাঁদের স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের বৈধতা নেই। আমাদের দেশে বিবাহ নিবন্ধনের ক্ষেত্রেও ইসলামি বিধিমোতাবেক ১৪ জন নারীকে বিয়ে করা হারাম। কিন্তু এঁদের কোনো শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্র আমাদের দেয়নি। তাই নিরাপত্তার কারণে তাঁদের এই সালিসে উপস্থিত করা হলো না। আমরা দুজনকে আইনের কাছে সোপর্দ করব।’
এ ঘোষণার পর উপস্থিত অনেকে ক্ষিপ্ত হয়ে মোতাহার চৌকিদারকে লাঠিসোঁটা নিয়ে তেড়ে আসে। চেয়ারম্যানের লোকজন পাল্টা ধাওয়া দিলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে মুরব্বিদের হস্তেক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এলাকার বাসিন্দা হাবিব বেপারী বলেন, ‘আমরা এলাকাবাসী যে কতটা কষ্টের মধ্যে আছি, তা বাইরের কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। বিষয়টির সুরাহা না হলে এলাকায় অঘটন ঘটতে পারে।’
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কায়ুম আলী সরদার জানান, সালিস-বৈঠক ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার কথা শুনেছি। এলাকাটি দুর্গম। পুলিশ পাঠানো হয়েছে
Post a Comment